দেবব্রত ঠাকুর, ধন্নিপুর: সকাল তখন সাড়ে দশটা। গুঁড়িয়ে দেওয়া বাবরি মসজিদের বিকল্প হিসেবে ধন্নিপুরে সরকারের বরাদ্দ করা সেই পাঁচ একর জমির প্রবেশপথে পৌঁছেই লাগল ধন্দ। এটাই কি সেই জমি? ধন্দ কাটল অবশ্য প্রবেশপথের ডান দিকের বোর্ডটা দেখে। বহুল-প্রচারিত সেই নকশা। "ইন্দো- ইসলামিক কালচারাল ফাউন্ডেশন"-এর বোর্ডে লেখা এবং ছবি গত তিন-চার বছরের রোদে-জলে হালকা হতে-হতে প্রায় মুছে যেতে বসেছে। পাঁচ একর জমির চারপাশে সিমেন্টের পিলারে কাঁটাতারের বেড়া। প্রবেশপথ বলা হলেও, ঢোকার মুখে কোনও গেট নেই। গরু-ছাগল চরছে। গ্রামের ছেলেরা এক ধারে ইটের ওপর ইট সাজিয়ে উইকেট তৈরি করে শীতের রোদে ক্রিকেট খেলছে। জমির মাঝখানে পিরের মাজার। সদ্য কলি ফেরানো হয়েছে। আর কোথাও কোনও নির্মাণের "নি" নেই।
মাজার-চত্বরের বাইরে গ্রামেরই এক বৃদ্ধ বসে। নাম, মহম্মদ ইসলাম খান। খানসাহেব পেশায় মজুর। তবে গত কয়েক দিন অযোধ্যার মন্দিরকে ঘিরে জেলাজোড়া ধুন্ধুমারে কাজে বেরোতে পারেননি তিনি। তাঁর কোলে বসে ফুটকি। না, ফুটকি কোনও মানবশিশু নয়। একটি ছাগশিশু। গা-জুড়ে বাদামি রঙের ওপরে সাদা ছোপ-ছোপ। সে-কারণেই তার নাম ফুটকি। গায়ে একটা সোয়েটার জড়ানো।
মসজিদ কবে হবে? বৃদ্ধের বক্তব্য, "জানি না। গত কয়েক বছর ধরে শুনছি মসজিদ হবে, হাসপাতাল হবে, কলেজ হবে। কোথায় কী! দেখছেন তো, একটা ইটও পড়েনি! ফাউন্ডেশনের লোকজন বছরে দু"বার আসে। ২৬ জানুয়ারি আর ১৫ আগস্ট। ভারতের জাতীয় পতাকা তোলা হয়, বক্তৃতা হয় আর মিষ্টি বিলিয়ে তাঁরা চলে যান। আর তো কিছুই হয় না! ছেলেরা খেলে, আমরা ছাগল-গরু চরাই। এপ্রিল মাসে উরস উৎসবকে কেন্দ্র করে শাহগদা শাহের মাজারের চারপাশে তিন দিন ধরে মেলা বসে। কাওয়ালি হয়। আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের হিন্দু-মুসলমানেরা কয়েকশো বছরের পুরনো এই মাজারে প্রার্থনা করতে আসেন। প্রদীপ জ্বালান। পাশের পিপুলগাছে সুতো বাঁধেন। মনস্কামনা জানিয়ে যান পির সাহেবের কাছে। এভাবেই চলছে।"
কথা হল তরুণ আকিবের সঙ্গে। ফৈজাবাদের আইটিআই থেকে ড্রাফট্সম্যানশিপের পরীক্ষা পাশ করে চাকরির জন্য আবেদনপত্র পাঠাতে শুরু করেছেন। এখনও কোনও জায়গা থেকে ডাক পাননি। মসজিদ হবে তো এখানে? আকিবের জবাব, "কবে হবে কে জানে!"
শুনেছি, হাসপাতাল হবে। একটা কলেজ হলে খুব ভাল হয়। আশপাশের এলাকার ছেলেমেয়েরা পড়তে পারবে। পাশে দাঁড়ানো মহম্মদ সাদিক। ক্লাস নাইনে পড়ে। না, কোনও মাদ্রাসায় নয়, সে পড়ে সরকারি হিন্দি বিদ্যালয়ে। সেখানে পড়লে ভবিষ্যতে চাকরি হবে, এই আশায়। এখানে ফাউন্ডেশনের পক্ষে জায়গার দেখভাল করেন সোহরাব খান। তিনি গ্রামের বাইরে গিয়েছেন। তাঁর সহযোগী তরুণ শাহবাজ খান। এলেন ফাউন্ডেশনের হয়ে কথা বলতে। তবে তিনিও জানেন না, কবে শুরু হবে নির্মাণ।
মসজিদের জন্য মক্কা থেকে পবিত্র ইট এসেছে বলে খবর রটেছে। ইটের ছবিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়েছে। শোনা যাচ্ছিল, ফেব্রুয়ারিতেই শুরু হবে নির্মাণের কাজ। কিন্তু জানুয়ারি শেষ হতে চলল। বৃদ্ধ ইসলাম খানের কথায়, "কাজ শুরুর প্রস্তুতি তা হলে তো কিছু দেখা যেত! কোথায় কী? ফৈজাবাদ-লখনউ হাইওয়ে থেকে শ"দুয়েক মিটার ভিতরে এই জমি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ছিল, অযোধ্যার মধ্যেই মসজিদের জন্য বিকল্প জমি দিতে হবে। যোগী সরকার রাতারাতি ফৈজাবাদ জেলার নাম বদলে অযোধ্যা করে আইন বাঁচিয়েছে। অযোধ্যানগরী থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে, অযোধ্যা জেলার মধ্যে জমি বরাদ্দ করা হয়েছে। চারপাশে আমবাগান। দশেরি, চৌসা, ল্যাংড়া আমের গাছ। উল্লেখ্য, এর মধ্যে মসজিদের পূর্বঘোষিত নকশায়
পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তন করা হয়েছে নামেরও। নতুন মসজিদের নামের মধ্যে বাবরি মসজিদের নামগন্ধটুকুও রাখা হয়নি। হজরত মহম্মদের নামে নতুন মসজিদের নামকরণ করা হয়েছে মুহম্মদ বিন আবদুল্লাহ্ মস্ক। মাজারের গায়ে নতুন মডেলের ছবি দিয়ে পোস্টার সেঁটেছেন ফাউন্ডেশনের কর্তারা। সরকার মসজিদ গড়ার জন্য ৫ কোটি টাকা দিয়েছে ফাউন্ডেশনকে। তবে মসজিদ, হাসপাতাল তৈরির জন্য সে-টাকা যথেষ্ট নয়। ফাউন্ডেশন টাকা তোলার চেষ্টা করছে। সরকারি সূত্রের খবর, মসজিদ তৈরির জন্য আগে আরব দেশগুলো থেকে যে-সহায়তা পাওয়া যেত, এখন আর তা মিলছে না। দেশের মুসলিম, খ্রিস্টান ইত্যাদি ধর্মীয় সংস্থায় বিদেশি অনুদান আসার সেই পথে নানা বাধা তৈরি করেছে মোদি সরকার। ফলে তহবিল জোগাড় করতে হিমশিম অবস্থা ফাউন্ডেশনের। কিছু দিন আগে মুম্বইয়ে ফাউন্ডেশন একটি বৈঠক করে। সেই বৈঠকে অর্থবান মুসলমানদের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা চাওয়া হয়েছে। এখন অপেক্ষা পর্যাপ্ত তহবিলের।